রবিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৯

নদীর কথা


কলেজের কাজ শেষ করতে করতে বিকেল হয়ে গিয়েছিলো।তার ওপর অতিরিক্ত কাজ।প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।সরকারী কলেজ হওয়াতে সারাদিনই টুকটাক কাজের জন্য কলেজ খোলা থাকে।
শীতের সন্ধ্যা।শরীরে কাপড় বলতে একটি চিকন কাপরের পাঞ্জাবী এবং একটি চাদর।ঠাণ্ডায় কাপতে কাপতে বের হলাম কলেজ থেকে।কাধে একটি শান্তিনিকেতন এর ব্যাগ।
বাড়িতে আর যেতে ইচ্ছা করছে না।কলেজের পিছনে একটি নদী আছে।অবশ্য শীত কাল হওয়াতে পানি শুকিয়ে গেছে।পাশের চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম।নদীর ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে এসে লাগছে।শরীরে চাদরটা জড়িয়ে নিতে নিতে দোকানদারকে বললাম,
_চাচা এক কাপ চা দিন।চিনি ছাড়া।
আমি যেন অন্যায় কোন কথা বলে ফেলেছি।হয়তো তার কাছে কোনদিন চিনি ছাড়া চা কেউ চায়নি।আর গ্রামের মানুষ প্রত্যেকটি বিষয়ে খুত খুতে।তারা চিনি ছাড়া চা খাবে এটা অস্বাভাবিক বলা চলে।
শুঁকনো মুখে চিনি ছাড়া চা বানাচ্ছে।এমন মনে হচ্ছে যেন সারা জীবনে এর চেয়ে বড় অপমান কেউ করেনি।
চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছি আর নদীর দিকে তাকিয়ে রয়েছি।ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় করে মাঝিরা বাড়ি ফিরছে।নৌকার মধ্যে কুপির আলো দেখা যাচ্ছে।তখন দোকানদার চাচা বলল
_বুঝলেননি স্যার এই নদীর কথা?বড়ই ভয়ঙ্কর হইয়া উঠে বন্যার কালে।
_হুম তা তো হবেই।
_কতো মাইনসেরে যে মরতে দেখছি এই নদীর বুকে তার ঠিক ঠাহর পাই না।
গ্রামের মানুষ।তাদের কথার ধরন খুব সহজ সরল হয়।তাছাড়া আমার মনেও একটু উত্তেজনা জেগে উঠলো।দুই মাস ধরে এখানকার কলেজে চাকরী পেয়েছি।এই কয়েক দিনেই যেন অনেক আপন মনে হয়েছে মানুষগুলোকে।আমি দোকানদার চাচাকে জিগ্যেস করলাম,
_প্রত্যেক বছরই কি মানুষ মারা যায় নাকি।
_তাইলে আবার কি কন?একজন দুইজন নি।
_তাহলে বলেন শুনি আপনার কথা।কীভাবে কি হয়।
_শুনেন তাইলে
“এই নদীডা আমার চোখে একটা পোড়া কপালি বুঝলেননি?গেলো বছর শহর থিকা একটা বাবু আইছিলো।আপনার মতনই ধলা শরিলের রঙ।তাও তার সাথে কয়েকজন পোলাপান আইছিলো।
আইছিলো কারেন্টের কাম করুনের লেইগা।তার মাঝখানে হগ্গলে মিলা নদীতে গোছল করতে নামলো।“
এইটুক বলে দোকানদার চাচা একটু পানি খাওয়ার জন্য থামল।বুঝতে পারলাম মানুষটি গল্প করতে ওস্তাদ বলা চলে।আমি বললাম,
_তার পর কি হলো বলেন
_তারপর কি হইলো শুনেন বাবু সাব
“নামছে তো।তাও ঘণ্টা খানেক ধইরা তারা নদীতে গোছল করলো।বাবু তো সেই রকম সাঁতার কাটতে পারে।হঠাৎ কি হইলো কে জানে বাবু দেহি এক চিক্কার দিয়া ডুইবা গেলো।কেউ কিছু বুঝনের আগেই সব শান্ত।হগ্গলে মনে করছিলো হয়তো বাবু মজা করতাছে কিন্তু না পাউন গেলো না।সগোলে মিলা অনেক খুজছে বাবুরে কিন্তু কোন লাভ হয় নাই।“
আমি বললাম,
_লোকটিকে কি আর পাওয়া যায়নি?
_পাউন যাইব না কেন?সাতদিন তো হইবই?হ সাতদিনই।
“সাতদিন পরে পাশের গ্রামের এক লোগ দেহে কি যে নদীর মধ্যে গাছ ভাইঙ্গা পইরা রইছে।তার মইদ্ধে উপ্তা হইয়া রইছে বাবু।হাত দুইডা ভাইসা রইছে।সগোলে যহন সিধা করলো তখন দেহি কি পুরা মুখটা পানিতে খায়া ফালায়ছে।ঘাউ ঘাউ অবস্থা।“
_চাচা এবার এই কথা বাদ দেন।এই ধরনের ঘটনা শুনতে ভালো লাগে না।মৃত্যুর এমন বিবরন দিবেন না?খুব কষ্ট লাগে।
_অহ বুঝছি, স্যার এর মনডা খুব নরম।যান বাদ দিলাম।
_তা এই নদী নিয়ে কি কোন ভালো ঘটনা নেই নাকি?
_আছে না স্যার।বহুত আছে।
_তা বলেন শুনি কি সেই ঘটনা?
_”এই নদীতে যহন বন্যা হয় না তহন সগোল জাইলারা কি আনন্দ কইরা মাছ মারে।সগোল দিকে মাছের ছড়াছড়ি।খালি মাছের নাচুন দেহি আমরা।আমার তো জাল নাই তাই কাপড় দিয়া নদীর কিনারে খালি পানি ছেচি।ছোড ছোড পুঁটি পাই তাই নিয়া বাড়ি যায়।“
দোকানদার চাচার কথা শুনে আমার মনটা খারাপ হয় গেলো।সত্যি তো হয়তো তারও জেলেদের মতো বড় জাল দিয়ে মাছ ধরতে মন চায় কিন্তু সামর্থ্য নেই যে।দোকানদার চাচা আবার বলতে শুরু করলো
_নদী এডা ভালো হউক মন্দ হউক আমরা এরে খুব আদর কইরা রাহি।মানুষ তো মরে তাগো নিজেগো দোষে।নদী তো কয় না তাগো নদীর বুকে যাউনের লাইগা
_হুম তা তো ঠিক।তা চাচা তোমার ছেলে মেয়ে কয়জন?
_ছিল একটা পুলা কিন্তু মাছ ধরতে যাইয়া ডুইবা মরছে ঝরের মধ্যে।এই পুরা কপালি নদী আমার পুলাডারে নিয়া গেছে।বাইচা থাকলে তোমার মতন হইতো।তাও নদিডা আমার খুব আদরের।
কথাটি আমার বুকের মধ্যে বিধলো।বাইচা থাকলে তোমার মতন হইতো।সত্যি খুব নিষ্ঠুর এই নদী কিন্তু সকলের খুব আদরের।
@SraNton Hossain

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

#শেষ_বেলা

এটিও কোন এক পোষ মাসের গল্প। আমার স্মৃতি শক্তি ম্লান হয়ে আসছে। এখন আর সকল কিছু ঠিকমতো মনে করতে পারি না। কতো শত গল্প যেন ঘন কুয়াশার আড়ালে আত্ম...