এটিও কোন এক পোষ মাসের গল্প। আমার স্মৃতি শক্তি ম্লান হয়ে আসছে। এখন আর সকল কিছু ঠিকমতো মনে করতে পারি না। কতো শত গল্প যেন ঘন কুয়াশার আড়ালে আত্মগোপন করেছে। হঠাৎ যখন কুয়াশার চাদর কিছুটা সরে যায় তখন মনে হয় যেন গল্পগুলোকে মনে করতে পারবো। কিন্তু হঠাতই কোথা হতে একঝাক কুয়াশা এসে আবারও তার সাদা চাদর দিয়ে সকল কিছুকে গ্রাস করে নেয়।
স্মৃতির দুনিয়ায় ভোরের সূর্যের অপেক্ষা করা একরকম পাগলামো। এখানে কখনো সূর্যের উদয় হয় না। দিন যতো যায় ততোই সে অস্ত যেতে থাকে। সেই সূর্যের এতোটাও শক্তি নেই যাতে করে সে ঘন কুয়াশার চাঁদরকে ভেদ করতে পারবে। সময় যতোই অতিবাহিত হয় ততোই এই দুনিয়ায় কুয়াশার শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সূর্য পশ্চিম আকাশে ডুবতে থাকে। এক সময় হালকা আধার এবং তার পরে গভীর রাত। সেই গভীর রাতে টিকে থাকার জন্য যুদ্ধ করতে করতে এক পর্যায়ে মানুষ হার মেনে নেয়। কনকনে ঠান্ডার সাথে গভীর অন্ধকারের যে মেলবন্ধন সেখানে মনুষ্য শরীর নিতান্তই অসহায়। স্মৃতিগুলো মনুষ্য শরীর থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে চলে। এক সময় সেই অসহ্য যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেয়ে যায়ও বটে।
আমি এখন জীবনের সূর্য ডোবার পূর্ব মুহুর্তে অবস্থান করছি। স্মৃতিগুলো এখনও কিছুটা স্পষ্ট কিন্তু বেশি সময় সেটুকুও রবে না। আজ থেকে পঁচিশ কি ত্রিশ বছর আগের ঘটনাগুলো খুব অল্পই মনে করতে পারি। তখন আকাশের ঐ সূর্যটি আমার নিকট রক্তের এক গোলকের মতো অনুভূত হতো। যে সূর্য সৃষ্টির অন্তিম পর্যন্ত মনুষ্য জাতির মধ্যে জীবনের সঞ্চালন করে চলবে।
কোন একদিন দুপুরের সূর্যটি মাথার ওপর উঠে অতিরিক্ত উষ্ণতা দেওয়ায় ব্যস্ত ছিল। সেদিন তার দিকে হাতের তালু উল্টিয়ে বলেছিলাম,
-"বাছা অনেক তো জ্বললে।এবার একটু রহম করো।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ হতে একটি মেয়েকে আসতে দেখছিলাম। কিছুটা অস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি যেন। পরিপূর্ণ রূপে তাকে কল্পনা করতে পারছি না। তার পরনে তাঁতের শাড়ি ছিল কি? হ্যা তাই হবে। কাঁধে একটি শান্তি নিকেতনের ব্যাগের মতো দেখতে একটি পাটের ব্যাগ। এটা বোঝা একেবারে কষ্টসাধ্য ছিল না যে মেয়েটি একটি খাঁটি বাঙাল বংশের মেয়ে। আমাদের মতো সুট টাই পড়া 'ডিফেকটিভ ব্যাঙ্গালী' নয়। মেয়েটির চেহারা মনে করতে পারছি না। উহু,কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
আমার পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া নাতনি আমাকে 'ওয়াটার ট্রিটমেন্ট' শিখিয়েছে। তার পদ্ধতিটি এমন যে ,
"কখনো কোন কিছু মনে করতে না পারলে বা মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলে লম্বা একটি শ্বাস নিয়ে মাথা পানির মধ্যে ডুবিয়ে দাও। তিরিশ সেকেন্ড পর মাথা উঠিয়ে আবার লম্বা এক শ্বাস নিয়ে আবার ডুবিয়ে দাও। এভাবে বেশ কয়েকবার করতে থাকো।"
এই ছোট্ট মেয়েটি এই বুদ্ধি কোথা হতে পেলো এটাই একটি ভাবনার বিষয়। আমি বেশ কয়েকবার উক্ত পদ্ধতি চেষ্টা করে দেখেছি। কাজ যে একেবারেই হয় না তেমনটি বলা ভুল হবে। আমি অন্তত গল্প লেখার সময় এর সুফল পেয়েছি।
কোথায় যেন ছিলাম? ওহ হ্যা মনে পড়েছে। সেই রোদ্রোতপ্ত দুপুরে আমার দিকে মেয়েটি হেটে আসছিল। অতি সন্নিকটে এসে বলেছিল,
-"মাহি ভাই,বাংলা স্যার যে টিকাগুলো দিয়েছিল সেগুলো কি আছে?"
মেয়েটির প্রশ্নের উত্তরে আমি কিছু একটি বলেছিলাম হয়তো। কিন্তু তা আর মনে পড়ছে না।
আমি তো প্রায় মৃত্যুর দোয়ারে পৌঁছেই গিয়েছি। জীবনের এই সময়টাতে সূর্য অনেক জলদি ডুবতে থাকে। এই যেমন দেখলাম যে সূর্য পশ্চিম আকাশে গাছগুলোর ওপর চুপ করে বসে রয়েছে। কিন্তু একটু পরেই সে উধাও হয়ে যাবে। একেবারে "ভ্যানিশ"।
বর্তমানে অনেক মহান বক্তিত্বদের মুখে শুনে থাকি যে ,মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব? কিন্তু তা কিভাবে সেটা আমার এই শান দেয়া ক্ষয়ে যাওয়া মগজে কিছুতেই ঢুকে না। আমাদের যে এতো অর্জন সকল কিছুই তো একদিন অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। তাহলে আমরা সৃষ্টির সেরা কি করে হলাম?
সেগুন কাঠের তৈরি পুরোনো ভারী জানালাটি বাতাসের ধাক্কায় খুলে গেলো। অনেক দূর হতে হিমেল বাতাস অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করে আমার শরীরে এসে লাগছে। ঠিক যেন মৃত্যু শীতল অনুভূতি। কালো চাদরটি ভালো মতো গায়ে জড়িয়ে নিলাম।
জানালা দিয়ে দূরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কুয়াশার চাদর কিছুটা সরে গিয়েছে। কে যেন চিৎকার করে উঠলো। হ্যা কে যেন পাহাড়ের ওপর হতে অনেক নীচে পরে যাচ্ছে। হ্যা একটি মেয়ে। এই মেয়েটির গায়েও তো বাসন্তী রঙের তাঁতের শাড়ি। তার কণ্ঠে বাঁচার আকুতি। তার সাথে কি যেন না পাওয়ার যন্ত্রণা। মেয়েটি চিৎকার করে বলছে,
-"মাহি ভাই আমি বাঁচতে চাই। আপনার হাত ধরে বাঁচতে চাই।"
পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি গগন বিদারী চিৎকার করে ওঠে।
'না,এ হতে পারে না। কে মারা গেলো? বাঁচাও মেয়েটিকে। কেও আছো?'
আমার শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে। বাড়ির সকলে ছুটে আসছে আমার দিকে। কে যেন উৎকন্ঠার সাথে বলে উঠলো,
-"আব্বাজান আপনার কিচ্ছু হবে না। এখনই এম্বুলেন্স আসছে।"
এতো কোলাহল কিসের জন্য। সবাই কেন এভাবে কান্না কাটি করছে? হঠাৎ কপালে ছোট্ট একটি হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে তাকাই। ছোট্ট একটি মেয়ে অশ্রু ভেজা চোখে বলে উঠলো,
--"দাদু আমি তোমার হিমাঙ্গিনী। আমায় ছেড়ে কোথাও যেও না প্লিজ।"
আমার চোখের কোণে পানি জমে ওঠার কারণ কি? হঠাৎ জানালার ধার থেকে মিষ্টি এক কন্ঠস্বর ভেসে আসলো।
-"মাহি ভাই মনে আছে আমায়? আমিই হিমাঙ্গিনী।"
মেয়েটির পুরো শরীর দিয়ে হালকা এক রশ্মি বের হয়ে আসছে। মেয়েটিও আমার মাথার কাছে বসে পড়লো। আমার দুই পাশে দুই পাশে দুই হিমাঙ্গিনী বসে রয়েছে। একজন কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু তা পুরাটাই ব্যার্থ চেষ্টা। আর অন্যজনের ঠোঁটে হালকা এক চিলতে হাসি। যে হাসির সৃষ্টি এই পৃথিবীতে নয়।
আমাকে এম্বুলেন্স এ তড়িঘড়ি করে ওঠানো হচ্ছে। আচ্ছা, আকাশের সূর্যটি হঠাৎ করে কোথায় চলে গেলো? নাহ দেখতে পারছি না তো। এতো অন্ধকার কেন চারপাশে। তাহলে কি আজই আমার স্মৃতিগুলোর শেষ দিন? হ্যা, তাই হবে।
এতো ঠান্ডা কেন চারপাশ। আচ্ছা সেই মেয়েটি কে যে পাহাড় থেকে পড়ে যাচ্ছিল? তাকে কি আমি চিনি?
অন্ধকার হতে সেই কণ্ঠটি আবার ভেসে আসছে।
-"মাহি ভাই চলো তবে আমার সাথে। স্মৃতিগুলো বিলীন হয়ে যাক মহামায়ার।"
আমি কিছু না বুঝেই মনে মনে উত্তর দিলাম,
-"তবে তাই হোক।"
ধন্যবাদ Jahidul Islam Jhonny দোস্ত।
Written by: SraNton Hossian