বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৯

নিশাচর

একটি বৃদ্ধ বটগাছের নিচে বসে রয়েছি।এখন লোকে যদি আমাকে পাগল ভাবে তাহলেও তাদের কোন দোষ দেওয়া চলে না।কেইবা এই পড়ন্ত বিকেলে গ্রামের বটগাছের নিচে পা ছড়িয়ে বসে থাকবে শুধু পাগল ছাড়া।
আচ্ছা এই বটগাছের বয়স কতো হবে?হয়তো একশো বছর অথবা তার চেয়েও বেশি।বলতেই হবে অনেক অভিজ্ঞতা এই বৃদ্ধ গাছটির যা তার ঝুলন্ত শেকড় গুলো দেখেই বোঝা যায়।
সূর্য মামা পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যাবে যাবে করছে।সে যেন খুব ক্লান্ত।তারও তো বিশ্রাম দরকার।হালকা এক টুকরো আলো চারপাশে অবশিষ্ট রয়েছে।সূর্য মামা ঘুমাবে আর চাঁদ মামা ঘুম থেকে জেগে উঠবে।
এমন সময় একটি লোক আমার পাশে এসে বসলো।পড়নে তার একটি লুঙ্গি আর একটি গামছা।লোকটি হয় কৃষক নাহয় দিন মজুর।লোকটি তার ঘর্মাক্ত শরীর গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বলল,
-“বুঝলেননি ভাইসাব আইজকা খুব গরম পরছিল।“
আমি শুধু বললাম,
-“হুম।“
-“ভাইসাব আপনে এই জায়গায় এমনে বইসা রইছেন যে?মাইনসে তো পাগল কইবো।“
-“কি করবো বলেন?আমি তো গন্তব্যহীন পথিক।পুরো পৃথিবীটাই যে আমার ঘর।“
লোকটি কিছুক্ষণ ভেবে বলল “হ বুঝছি”।এখন লোকটি কি বুঝেছে সেটা সেই জানে।অবশ্য গ্রামের মানুষকে অতো জটিল প্যাচ নিয়ে ভাবতে হয় না।তারা যেটুকু জানে সেটুকু দিয়ে নিজের মতো করে বুঝে নেয়।সেটি হোক ঠিক বা ভুল তাতে তাদের জীবন ধারায় কোন পরিবর্তন আসেনা যে।
দিনের শেষ আলো টুকুও নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে।মন চাইছে এখানেই মাটির বুকে শান্তিতে শুয়ে পড়ি।খুব ক্লান্তি অনুভব করছি।কেন এতো ক্লান্ত আমি?জানিনা,আর জানার প্রয়োজনও নেই।এমন সময় লোকটিকে দেখলাম একটি গামছার গেরো খুলছে।ভেতর থেকে একটি ঢাউস আকারের প্লাস্টিকের বাটি আর তার ভেতর দলা পাকানো লাল লাল ভাত আর কয়েক টুকরো আলু।বুঝলাম এগুলোই লোকটির রাতের খাবার।
লোকটি বাটির ঢাকনায় করে ভাত দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিলো।আর বলল,
-“নেন ভাই খান।যা আছে দুইজনে মিলা খাই।“
ভাতের সাথে এক টুকরো আলুও পেলাম।খাবার হিসেবে খুবই নিম্নমানের খাবার কিন্তু ভালোবাসা আর অনুভূতির দিক থেকে পৃথিবীর সেরা খাবার এটি।ভাত খেয়ে একটি ছোট্ট ঢেকুর তুলে বললাম,
-“ভালোবাসার আহার সকলের যেন মিলে,ভিক্ষার আহার নয়।“
লোকটি কি বুঝল কে জানে।মুখে খাবার নিয়ে আমার কথায় ঘন ঘন মাথা নেড়ে গেলো শুধু।
দূরে কয়েকটি ক্ষুদ্র কুটির দেখা যাচ্ছে।কুটিরের ভেতর কুপী বাতির আলো এবং তার সামনে বাচ্চারা বই খাতা নিয়ে পড়তে বসেছে।
লোকটির খাওয়া মাত্র শেষ হল।লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম,
-“ভাই সাহেবের নাম কি?”
-“ইদ্রিস মিয়া”
-“বাড়ি না গিয়ে এখানে এসে খাবার খাচ্ছেন যে,বাড়ি যাবেন না?”
-“আপ্নের মতন পৃথিবীটা আমার ঘর।সারাদিন বাবুর ক্ষেতে কাম করি তারপর জেইহানে রাইত সেইহানেই কাইত।“
ইদ্রিস মিয়ার কথাটি বেশ লাগলো।কিছুক্ষণ কথাটি আওড়াতে থাকলাম,
-“যেখানে রাত সেখানেই কাত।“
ইদ্রিস মিয়াকে আবার প্রশ্ন করতে যাবো কিন্তু দেখি মহাশয় চার হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেছে।পাশে খাবারের বাটিটা পড়ে রয়েছে অযত্নে।
ইদ্রিস মিয়া আজকে আমার খাবারের যোগান দাতা সেদিক থেকে লোকটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।কিন্তু তাকে বিনময়ে দেওয়ার মতো আমার কাছে কিছুই নেই।আমার এক মাত্র সম্পদ বলতে একটি আধ ছেড়া ডাইরি।ডাইরিটি ইদ্রিস মিয়ার মাথার পাশে রেখে দিয়ে হাটতে শুরু করলাম অজানার উদ্দেশ্যে।হয়তো ইদ্রিস মিয়ার কাছে আমার ডাইরিটি একটি জঞ্জাল ছাড়া কিছুই নয়।হয়তো ডাইরিটি ফেলে দেবে পাশের ডোবায়।তবুও মনে করি তাকে কিছু দেওয়া উচিৎ তাই দিয়েছি।
আচ্ছা সকল ঋণ কি পরিশোধ করা যায়?হয়তো নয়।
ইদ্রিস মিয়া সারা বছর এই মাটির সংস্পর্শে থাকে।সেদিক থেকে বলতে গেলে তার সাথে মাটির এক নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।আমার সাথেও কি মাটির এমন নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়েছে?আমিও তো উনারই মতো।
একটি ক্ষুদ্র কুটিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কিছু কথা শুনতে পেলাম,
-“চার এক্কে চার।চার দুগুণে আট।“
-“কিরে আর কতক্ষণ ধইরা একই নামতা পড়বি?”
-“এইতো হইয়া গেছে মা।এখনই বাংলা কবিতা পড়ুম।“
-“হ হ পড়।তুই বড় হইয়া ডাক্তার হইয়া না মাইনসের সেবা করবি?ভালো কইরা পড়।“
-“হ মা পড়তাছি।“
সত্যি পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের একটি ইচ্ছা থাকে।এখানে মায়ের ইচ্ছা তার ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে,গরিব মানুষের চিকিৎসা করবে।ছেলের ইচ্ছা বড় হয়ে ডাক্তার হয়ে পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করবে।আর আমি নিশাচর মানুষ যে কিনা দিনে বিশ্রাম করে আর রাতে ঘুরতে বের হয়।
আমার আব্বু আম্মু আমার কাছ থেকে যেন কি আশা করেছিলো ঠিক মনে করতে পারছি না।অনেকগুলো বছর মাঝে পার হয়ে গিয়েছে কিনা।না থাক সেসব না ভাবাই ভালো।
বেশ তো আছি যেমনটি আছি।
SraNton Hossain

বুধবার, ২ অক্টোবর, ২০১৯

প্রজন্ম





আমি মৃত্যুবরণ করতে চাইনা।পৃথিবীর সাথে সম্পর্কের বাধন হতে মুক্তি পেতে চাইনা,চাইনা পরিবারের কেউ আমাকে ছেড়ে চলে যাক না ফেরার দেশে।কিন্তু তা যে কখনো সম্ভব নয়।
আমাদের দাদুভাই আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন মেঘের ওপারে।আব্বু তাঁর ছোটবেলার গল্প করেন আমাদের সঙ্গে।আব্বু নাকি প্রতিদিন দাদুভাই এর হাত ধরে ঘুরতে যেত।এখন আমাদের মাঝে সেই দাদুভাই আর নেই।
মনে পরে যখন চাচাতো ভাইয়ার বিয়েতে দাদুভাই অনেক শখ করে তাঁর দুধের মতো সাদা দাড়িতে মেহেদী দিয়ে লাল করে ফেলেছিল,মনে পরে যখন ঈদের লুঙ্গী পছন্দ না হলে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতো,মনে পরে যখন দাদুভাই নামাজ শেষে আমাদের সব ভাই বোনেদের জন্য জিলাপী কিনে আনত।
দাদুভাই এর ব্যাপারে আব্বুর সাথে কথা বলতে বলতে আমার চোখ চক চক করে ওঠে।
আজ থেকে চল্লিশ বছর পর হয়তো আব্বুও আমাদের ছেড়ে চলে যাবে।তখন কি আমিও খুব কান্না করবো?এই কথা ভাবতেই গলার কাছে কি যেন একটি আটকে আসার অনুভূতি হচ্ছে।
তখন হয়তো আমিও আব্বুর মতো ছেলের ভূমিকা পালন করবো।আমার ছেলে-মেয়েদের কাছে আব্বুর সম্পর্কে অনেক গল্প করবো।হয়তো তখন আমার চোখের কোনে এক ফোটা পানি জমে উঠবে।
কিন্তু এখানে একটি ভাবনার বিষয় রয়েছে।চল্লিশ বছর পর যখন আব্বু মারা যাবে তখন আমিও মধ্য বয়স্ক হয়ে যাবো বলা চলে।তখন দাদুভাই এর খুব হালকা স্মৃতিই অবশিষ্ট থাকবে আমার কাছে।সেই অবশিষ্ট স্মৃতি টুকু আমার ছেলে-মেয়েদের মনে প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে হয়না।
যখন আমি বা আমাদের প্রজন্ম পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে তখন দাদুভাইকে মনে রাখার মতো কেউ থাকবে না।হয়তো তখন আমার ছেলে মেয়েরা বলবে,
-“আমার আব্বু মাঝে মাঝে তাঁর দাদু সম্পর্কে গল্প করতো।“
এতটুকুই।কিন্তু তাকে স্মৃতির পাতায় মনে রাখার মতো কেউ থাকবে না।আমার দাদু বলে যে কেউ ছিল সেটি যেন এই পৃথিবীই ভুলে যাবে।এমন ভাবে যতই প্রজন্ম পরিবর্তন হতে থাকবে ততোই আমরাও পৃথিবী থেকে মুছে যাবো।যেমনটি হয় যখন আমরা রাবার দিয়ে অপ্রয়োজনীয় লিখা গুলি মুছে ফেলি।
এসব চিন্তা করলে মনে হয় এই বেচে থাকার কোন মানে নেই।একদিন তো মারা যেতেই হবে,একদিন তো পৃথিবীর মানুষরা ভুলেই যাবে আমার কথা।
যদি ভবিষ্যতে আমার অনেক টাকা হয় তারপরও কি আমার কোন লাভ হবে?
হবে না।
কোন প্রতিপত্তিও আমাকে মানুষের মনে বাচিয়ে রাখতে পারবে না।
কিছু কিছু মানুষ রয়েছে যারা তাদের সৃষ্টিকর্মের দ্বারা চিরো স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।তাদের প্রতিভা দিয়ে পৃথিবীর অনেক মানুষের মনে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছে।কিন্তু সেরকম কোন গুণ তো আমার কাছে নেই।
সেরকম দুজনের নাম এখন মনে পড়ছে।
একজন হচ্ছে “রেবেকা শফি”।জন্ম ১৯৭৮ সালে।১৯৯৩-১৯৯৪ সালে তাঁর বয়স যখন ১৫ তখন বিদ্যালয়ের একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সে অংশগ্রহণ করে।দীর্ঘ ২৬ বছর পর কোন এক ব্যক্তি সেই ভিডিওটি অনলাইনে প্রকাশ করে দেয় যাতে করে সকলে তাঁর কথা শুনতে পারে।তাঁর বাচন ভঙ্গি এবং বাংলা উচ্চারণ শুনে আমি স্তব্ধ।এক কথায় আমি তাঁর কথা বলার প্রেমে পড়ে যাই।এতো সুন্দর করে কেউ বাংলা উচ্চারণ করতে পারে সেটি আমার জানা ছিলনা।
এই “রেবেকা” মানুষের মনে ঠিকই দাগ কাটতে পেড়েছে।
আর একজন হচ্ছে “তাহমিদা জান্নাত”।২০১৪ সালে ফেসবুকে একটি লিখা দেওয়া হয়।২০১৩ সালের ৭ মার্চ থেকে ২০১৪ সালের ২৫ মে হচ্ছে সেই লিখার আয়ুষ্কাল।এই সময়ে “তাহমিদা” এর ক্যান্সারের বিষাদময় জীবন কেমন কেটেছে তা লিখা হয়েছে।২০১৪ সালের ২৭ মার্চ লিউকোমিয়ার কাছে হার মানতে হয় তাহমিদার।কিন্তু সে কিন্তু মানুষের মন থেকে মারা যায়নি।তাঁর লিখার ভাষা দেখে কতো মানুষ যে কান্না করেছে তাঁর কোন ঠিক নেই।তাঁর অনুভূতিগুলো অনেক মানুষের মনে দাগ কেটে গিয়েছে।
হয়তো মৃত্যুর মুখোমুখি না হলে এমন ভাষায় লিখা সম্ভব নয়।
আমি আমার শেষ জীবনে কোন একটি বরফের দেশে থাকতে চাই যেখানে সারা বছর ধরে বরফ পড়বে।রাতে যখন কনকনে ঠাণ্ডা পড়বে তখন খোলা আকাশের নিচে চাদর মুরি দিয়ে পরিষ্কার তারা ভরা আকাশ দেখবো।অনুভব করবো তারাদের স্পর্শ,অনুভব করবো চাদের আলো।কল্পনা করতে থাকবো যখন আমি তারাদের দেশে চলে যাবো তখনটি কেমন হবে।
আমি অধিকার রাখিনা পৃথিবীর মানুষের মনে জায়গা করে নেওয়ার।আমি এতো তুচ্ছ যার জায়গা পৃথিবীতে নয়।
আচ্ছা বরফের দেশে কি আমার প্রিয় ফুলগুলোর সুবাশ পাওয়া যাবে?হয়তো নয়।তবুও আমি সেই মৃত্যু শীতল করা অনুভূতির মধ্যে জীবন ত্যাগ করতে চাই যেখানে তারারা আমাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে এবং খিল খিল করে হাসবে।
@SraNton Hossain

#শেষ_বেলা

এটিও কোন এক পোষ মাসের গল্প। আমার স্মৃতি শক্তি ম্লান হয়ে আসছে। এখন আর সকল কিছু ঠিকমতো মনে করতে পারি না। কতো শত গল্প যেন ঘন কুয়াশার আড়ালে আত্ম...