রবিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৯

অসমাপ্ত কথামালা


★উরমিলা
জন্মঃ১০ জুন ২০০৩
আমাদের মনোজগৎটি  বেশ জটিল।হয়তো এই জটিল হওয়াটিই স্বাভাবিক।
মেয়েটির নাম কি?জানিনা।তার জন্ম কতো সালে?তাও জানি না।এখন অনেকেই বলতে পারেন,
--"তাহলে বাপু নাম আর জন্ম তারিখ দিয়ে শুরু করার মানে কি?"
আমি বলবো,
--"জানিনা কিছুই জানিনা।"
আজ থেকে পাচ কি ছয়টি বছর যেমন তেমন ভাবে হয়েই যাবে।সময়টি একটি শীতের সকাল।বাস থেকে নেমেছি,কোচিং ক্লাস আছে যে।চারপাশ যেন কুয়াশার চাদরে ঢাকা।তাই বলে অতোটাও নয় যে দশ হাত সামনে কিছু দেখা যাবে না।বাসের হেল্পার এক কথায় চিৎকার শুরু করেছে,
--"আরে মামু গাড়ির সামনে থন হরেন।"

তাই তো, আমি তো বাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।বাসের সামনে থেকে সরে আসলাম।আর মিনিট পাচ হাটলেই কোচিং ক্লাসে পৌছে যাবো।হঠাৎ করে কোথা থেকে হিমেল হাওয়া এসে কাপুনি ধরিয়ে দিয়ে গেলো।এখন মনে হচ্ছে এই ভরা শীতে পাঞ্জাবি আর চাদর গায়ে দিয়ে আসা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়।

রাস্তার পাশে যে বড় একটি পুকুর রয়েছে সেটি এতোদিন আমার নজরেই আসেনি।কিন্তু কেন আসেনি?হয়তো প্রকৃতি চায়নি তাই আসেনি।পুকুরের পাশ একটি বসার জায়গা করা আছে।বেশ মানিয়েছে এই পুকুর আর বসার জায়গাটি। ভাবছি আজ আর কোচিং এ যাবো না।কখনো নিয়মের বাইরে করা যাবে না এটা কোন সাধক বাবা বলেছে?আমি তো শুনিনি।
পুকুরটির পাশে যেতেই দেখলাম ব্রেঞ্চটির মাঝে একটি মেয়ে বসে রয়েছে।মুখের দিকে তাকাতেই আমি বিদ্যুতে শক খাওয়ার মতো দু পা পিছিয়ে আসলাম।এই সৌন্দর্যের কোন বর্ণনা দেওয়া চলেনা হয়তো।তাই আমিও না দেই।
শরীরে একটি কালো চাদর জড়ানো।একেবারে নিরেট কালো।হয়তো বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়েছে।ঠিক বুঝতে পারছি না যে।তার ওপর কুয়াশা যেন আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।মেয়েটির চুলগুলো বাচ্চাদের মতো একটি ঝুটি করা।অপরুপ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছি।সকল সৌন্দর্য যেন মেয়েটির জন্যই তৈরি।

হয়তো মেয়েটির আমার সম্পর্কে বাজে ধারণা তৈরি হবে।কি আর করার।সত্যি কিছুই করার নেই।মেয়েটি আমার দিকে একবার তাকালো।সেই চোখে রাজ্যের বিষন্নতা।কেন এরকম বিষন্নতা।এটা উচিৎ নয়,একেবারেই উচিৎ নয়।হঠাৎ করে সেই হিমেল হাওয়া কোথা থেকে আবার উদয় হলো।মনে হচ্ছে এই ঠান্ডার অনুভূতি যেন শরীরে বিধে যাচ্ছে।নিজেকে কোনমতে ঠিক রেখে হাতে হাত ডলতে ডলতে পুকুরের দিকে ঘুরে দাড়ালাম।
বেশ অনেক সময় মাঝে পার হয়ে গিয়েছে।দশ মিনিট তো হবেই।আমি ধারণা করলাম মেয়েটি আমার উপস্থিতিতে অস্বস্থি বোধ করে হয়তো চলে গিয়েছে।হঠাৎ করেই নুপুরের মতো হালকা কন্ঠে বলে উঠলো,
--"এই ঠান্ডার মাঝে এভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছেন যে?অসুস্থ হয়ে যাবেন তো।"
আমি ঘুরে তাকিয়ে বললাম,
-"আপনিও তো একটি চাদর গায়ে দিয়ে বসে রয়েছেন।আপনার ঠান্ডা লাগে না?"
-মেয়েটি হয়তো কিছুটা দমে গেলো।দেখলাম মেয়েটি ব্রেঞ্চের এক পাশে সরে গিয়ে আমাকে বসার জন্য জায়গা করে দিলো।ব্রেঞ্চে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলাম,
--"এই সকালে কনকনে ঠান্ডার মাঝে বসে রয়েছেন কেন?"
মেয়েটি বলল,
--"আমার কথা আমাকেই ঘুরিয়ে দিলেন?"
বলেই খিলখিল করে হেসে দিলো।হয়তো সেই হাসির মাঝে আত্মার পরিশুদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছে।আমিও নিজের অজান্তেই হেসে দিলাম।কিন্তু সেই হাসিতে অসুস্থতা মিশে রয়েছে ভয়ানক ভাবে।নিজেকে বড় ক্লান্ত মনে হচ্ছে।এই কনকনে ঠান্ডা আর আমি যেন একই অস্তিত্ব।চোখে ঘোর লেগে রয়েছে কিন্তু মন যেন শরীরের বিরুদ্ধে চলছে।আমি জিজ্ঞেস করলাম,
--"নাম কি আপনার?"
--"জানিনা।"
--"বলতে চাইছেন না তাই তো?"
--"ঠিক তেমনটি নয় আবার ঠিক তেমনই। "
মেয়েটি বেশ ঘুরিয়ে কথা বলতে পারে।কিন্তু কণ্ঠে তার বাচ্চাদের মতো সরলতা সকল সময়ই লক্ষ্য করছি।নাহ এভাবে মেয়েটি মেয়েটি করতে ভালো লাগছে না।নাম দিলাম উরমিলা।

উরমিলা হঠাৎ করে বলে উঠলো,
--"সাহিত্য বিষয়ে কতোটুকু জানেন?মানে সাহিত্য বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করেছেন কী?"
সেই অসুস্থতা মিশে থাকা হাসি দিয়ে বললাম,
--"সাহিত্য বিষয়ে জানতে হলে সেই বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করতে হয় বুঝি?"
--"তা কতোটুকু জানেন?"
--"চালিয়ে দেওয়ার মতো।"
--"হু।"

আসুস্থতা হাজার গুনে বেড়ে গেলো হয়তো।মাথার ভেতর সুই ফোটার মতো যন্ত্রনা হচ্ছে।মুখ দিয়ে নিজের অজান্তেই তীব্র চিৎকার বাহির হয়ে আসলো।পারছি না আর,একেবারেই পারছি না।উরমিলার কোলে ঢলে পড়ে গেলাম।কিছুক্ষণ পর উরমিলা বলল,
--"চিন্তা করবেন না।হাসপাতালে ফোন করে দিয়েছি।গাড়ি আসবে কিছুক্ষনের মাঝে।"
কি অদ্ভুত মেয়ে।গলায় কোন কম্পন অনুভব করতে পারছি না।সে যেন একটি পাথরের ন্যায় কঠিন।
আমি বললাম,
--"আপনার নাম কি?আপনার বাড়ি কোথায়?বেচে থাকলে অসম্পূর্ণ কথাগুলো সম্পূর্ণ করতে চাই।"
--"প্রকৃতিই হয়তো চায়না কথাগুলো সমাপ্ত হোক।আমরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারি না।"
--"তাহলে আমাদের আর দেখা হবে না?"
--"হয়তো না আবার হয়তো হ্যা।"
ভেতর থেকে ডুকরে কান্না আসতে চাইছে।কিন্তু কেন?উরমিলার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হতে পারেনা।কেননা ভালোবাসা প্রচন্ড জটিল একটি বিষয়।হয়তো উরমিলার মনের ভাব জানার প্রচন্ড আগ্রহ তৈরি হয়েছে তাই এমন কান্না আসছে।
এম্বুলেন্স এসে গিয়েছে।উরমিলা আমার কপালে হাত রেখে বলল,
--"সুস্থ হয়ে যাবেন।হয়তো দেখা হবে কোনদিন। "

★মাঝে পাচটি বছর কেটে গিয়েছে।অনেক সময় বলা চলে।সুস্থ হওয়ার পর অনেকবার গিয়েছি সেই পুকুর পারে কিন্তু উরমিলার দেখা পায়নি।অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু সম্ভব হয়নি।এই পাচটি বছরে জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি মাসে অনেকবার করে গিয়েছি সেই জায়গায়।মনে অনেক আশা ছিলো হয়তো দেখা হবে,হয়তো সেই তীব্র শীতে সেই ব্রেঞ্চটিতে উরমিলাকে দেখতে পাবো।হয়তো।যদিও ব্রেঞ্চটি আর আগের মতো নেই।তার শরীরে যেন ঘুন বাসা বেধেছে।অনেকটাই যেন মলিন বদনে বসে থাকে সে।   হয়তো উরমিলার কথাই ঠিক,
--"প্রকৃতির বিরুদ্ধে কিছুই করার ক্ষমতা নেই আমাদের।"

★আজ আবার বেড়িয়েছি উরমিলার খোজে।হয়তো দেখা হয়ে যাবে।এই টহল বন্ধ করা যাবেনা যে।যদি এমন হয় যে আমি উরমিলার খোজে যাইনি আর সেদিনই সে এসেছিলো।নাহ এটা করা যাবে না।
আজ অবশ্য আর পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে আসিনা কিন্তু চাদরটা তার জায়গায় ঠিকই থাকে।হেটে যাচ্ছি তো হেটেই যাচ্ছি।হাতে আধ পোড়া সিগারেটটি সে নিজেকে পুড়িয়ে যাচ্ছে অনবরত।
পুকুরটির সামনে কে যেন দাড়িয়ে রয়েছে।হ্যা তাই তো মনে হচ্ছে।এতো দূর থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না ঠিক।পুকুর ধারে যেতেই ঘুরে তাকালো সে।চোখে একটি হালকা ফ্রেম এর চশমা,গায়ে নিরেট কালো চাদর।হ্যা উরমিলাই তো।আমি তাকিয়ে রয়েছি অপলকভাবে ঠিক সেদিনের মতো।উরমিলার মাথায় বাচ্চাদের মতো ঝুটিটি আর পরিলক্ষিত হচ্ছে না।তাতে কি এক অন্যরকম মহিমা তাকে যেন ঘিরে রেখেছে।উরমিলা বলল,
-"সিগারেট খাচ্ছেন যে।শরীর খারাপ হয়ে যাবে তো।"
আগের ভাবেই যেন কথাগুলো বলল সে।আমি বললাম,
-"প্রকৃতির ইচ্ছাই তাহলে আবার দেখা হওয়া।
উরমিলার মুখে  স্নিগ্ধ হাসি লেগে রয়েছে যা সেই দিন ছিলো না।     

Written By:#SraNton_Hossain; #Nayma_Islam

#শেষ_বেলা

এটিও কোন এক পোষ মাসের গল্প। আমার স্মৃতি শক্তি ম্লান হয়ে আসছে। এখন আর সকল কিছু ঠিকমতো মনে করতে পারি না। কতো শত গল্প যেন ঘন কুয়াশার আড়ালে আত্ম...